বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার মান, শিক্ষার পরিবেশ, কাজের সুযোগ, গবেষণার সুযোগ ভালো হওয়ায় প্রতিবছর এইচএসসির পর বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়।
আপনিও যদি এইচএসসি কিংবা স্নাতক শেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার কথা ভাবেন তাহলে আজকের ব্লগটি আপনার জন্য খুবই উপকারী হবে। বিশেষ করে এইচএসসির পরে বিদেশে উচ্চশিক্ষা বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
আজকের এই ব্লগে আমরা বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ পাওয়ার যোগ্যতা ও উপায় এবং স্টুডেন্ট ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা বিস্তারিত গাইডলাইন উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পরিকল্পনা
যেকোনো কাজের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে সে বিষয়ে উত্তম পরিকল্পনার উপরে। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে প্রথমেই একটি সুন্দর ও গোছালো পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। পরিকল্পনাটা অবশ্যই লিখিত হলে ভালো হয়।
আর এই পরিকল্পনা এইচএসসি পরীক্ষার পরে শুরু করলে তা অনেক দেরি হয়ে যাবে। এজন্য এইচএসসি পরীক্ষার কমপক্ষে ৬-৮ মাস আগে থেকে পরিকল্পনা করা উচিত।
কেননা, বিদেশে উচ্চশিক্ষা আপনার ভবিষ্যৎ জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হবে। আর এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মোটেই তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।
তাই আপনার হাতে যদি এখনো ৬-৮ মাস সময় থাকে এবং আপনি বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান তাহলে এখন থেকেই পরিকল্পনা শুরু করে দিন। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পরিকল্পনা কীভাবে করবেন, তার একটি সুন্দর আউটলাইন দেওয়ার চেষ্টা করবো।
লক্ষ্য নির্ধারণ
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথমেই আপনাকে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। আপনি কেন বিদেশে পড়তে চান তার উত্তর খুঁজে বের করুন।
এলাকার অমুক ভাইয়া বা আপু পড়তে যাচ্ছে, অমুক আত্মীয়ের ছেলে কিংবা মেয়ে পড়তে যাচ্ছে তাই আমাকেও যেতে হবে, এমন চিন্তা থেকে বের হয়ে আসুন।
উচ্চশিক্ষার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ আপনার পরবর্তী জীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাব রাখবে। এছাড়া এখানে আর্থিক সক্ষমতার বিষয়, নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করা, এসব দিক বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তা আপনার জন্য ভালোর পরিবর্তে হিতে বিপরীত হতে পারে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ
আগেই বলেছি, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার কথা ভাবলে অন্তত ৬-৮ মাস পূর্ব থেকেই পরিকল্পনা করা উচিত। পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ এরই একটি অংশ।
পূর্বপ্রস্তুতি বলতে আপনাকে আগে থেকেই নির্ধারণ করতে হবে আপনি কোন দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান, কোন বিষয়ে পড়বেন, কোন শহরে থাকবেন ও সেখানকার খরচ কেমন, যে দেশে পড়তে চান সেখানে কী কী ভাষাগত দক্ষতা প্রয়োজন, কোন কোন দেশে কী কী স্কলারশিপের সুযোগ আছে, স্টুডেন্ট ভিসার যোগ্যতা ও আবেদন প্রক্রিয়া ইত্যাদি। আগে থেকেই আপনাকে এসব বিষয়ে অনলাইনে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিতে হবে।
অনলাইনে অনেক ওয়েবসাইট, ব্লগ, সরকারি পোর্টাল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব ওয়েবসাইটে এসব তথ্য পাওয়া যায়। এই ব্লগের একাংশে আমরা এসব তথ্য-ও শেয়ার করবো।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ভাষাগত দক্ষতা অর্জন
বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে মাথাব্যথার কারণ হয় যে বিষয়টি তা হলো ভাষাগত দক্ষতা অর্জন। যেহেতু ইউরোপ ও আমেরিকার অধিকাংশ দেশগুলোতে ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয় সেজন্য ভাষাগত দক্ষতা বলতে মূলত ইংরেজি ভাষায় পারদর্শীতাকে বুঝানো হয়। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার মানদণ্ড হিসেবে দেশগুলো IELTS ও TOEFL এর স্কোরকে বিবেচনা করে।
ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষতা অর্জন করতে আপনাকে এইচএসসির আগেই ভালো কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে IELTS বা TOEFL এর কোর্স করে ভালো স্কোর অর্জন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলোর ব্যান্ড স্কোর ৬ হলেই চলে।
তবে যারা আমেরিকায় সাইন্স ফ্যাকাল্টির কোনো বিষয়ে পড়তে চান তাদের জন্য GRE (Graduate Record Examination) এবং যারা বিজনেস স্টাডিজ কিংবা আর্টসের বিষয়ে পড়তে চান তাদের জন্য GMAT (Graduate Management Admission Test) এর দক্ষতা প্রয়োজন হবে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই
উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত। শিক্ষার মান, সহশিক্ষা কার্যক্রম, পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ, পড়াশোনা ও থাকা-খাওয়া খরচ, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কোন দেশে পড়তে যেতে চান। কারণ, একেক দেশের শিক্ষার মান, টিউশন ফি ইত্যাদি আলাদা। তাই আগে থেকেই ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে সে দেশ সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন।
দেশ বাছাই করার পর আপনার যোগ্যতার সাথে মিল রেখে সে দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা তৈরি করে সেগুলো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে সিদ্ধান্ত নিন। এ কাজগুলো সময় নিয়ে করতে হবে, এজন্য কয়েক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
এছাড়া বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য কীভাবে বিষয় বাছাই করতে হয় সে বিষয়ে বিস্তারিত গাইডলাইন পেতে চাইলে এই ব্লগটি পড়তে দেখতে পারেন।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ খোঁজা
বাংলাদেশের তুলনায় বিদেশে পড়াশোনা বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেরই সেই ব্যয় বহন করার সক্ষমতা থাকে না। এক্ষেত্রে সবারই ইচ্ছে থাকে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করা। কিন্তু সঠিক তথ্যে বা গাইডলাইনের অভাবে আর এগোতে পারে না।
ব্লগের এই অংশে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ সম্পর্কে আমরা সংক্ষেপে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার চেষ্টা করবো।
বিদেশে স্কলারশিপ পাওয়ার যোগ্যতা
বিদেশে স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে আপনার কিছু যোগ্যতা লাগবে। তবে এমন কিছু যোগ্যতা রয়েছে যা সব স্কলারশিপের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন। যেমন-
- ভাষাগত দক্ষতাঃ ভাষাগত দক্ষতা বোঝাতে IELTS ও TOEFL কে বুঝানো হচ্ছে। আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের মতো দেশে পড়তে অন্তত স্কোর ৬ থাকলেই হয়। তবে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে আপনাকে আরো বেশি স্কোর অর্জন করতে হবে, মোটামুটি ৭-৭.৫। এছাড়া ফ্রান্স, জার্মানিতে স্কলারশিপ পেতে গেলে সে দেশের ভাষা শেখার প্রয়োজনও হতে পারে।
- লেটার অব রেকোমেন্ডেশনঃ Letter of Recommendation হলো বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য সুপারিশ পত্র, যা শিক্ষার্থীর প্রাক্তন শিক্ষক কিংবা কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা দিয়ে থাকে। এটা মূলত আপনার কর্মদক্ষতা, সহশিক্ষা কার্যক্রম, ব্যক্তিগত গুণাবলির তথ্য তুলে ধরে।
- স্টেটমেন্ট অব পারপাসঃ Statement of Purpose বলতে বুঝায় আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা দেশে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করবেন সেখানে কেন পড়তে চান, আপনার উদ্দেশ্য কী সে সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করে একটি চিঠি লেখা।
বিদেশে স্কলারশিপ পাওয়ার উপায়
বিদেশে স্কলারশিপ পাওয়ার প্রথম উপায় হলো সেখানকার প্রচলিত স্কলারশিপ সম্পর্কে জানা। জার্মানি, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড এর দেশগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে কিংবা আংশিক খরচে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হয়।
এছাড়া এসব দেশের অনেক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়-ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের এই সুযোগ দিয়ে থাকে। প্রথমে আপনার কাঙ্ক্ষিত দেশের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আগ্রহী সেটার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে খোঁজ করুন, সেখানে স্কলারশিপ সম্পর্কিত তথ্য দেওয়া থাকবে। সেখানে তথ্য না থাকলে তাদের ইমেইল ঠিকানায় মেসেজ করেও এ বিষয়ে তথ্য চাইতে পারেন।
আবার কিছু ব্লগ ও ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে এসব বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া বিদেশে সরকারি স্কলারশিপের জন্য সে দেশের সরকারি ওয়েবসাইটেও খোঁজ রাখতে পারেন। নিচে এমন কিছু দেশের স্কলারশিপের ওয়েবসাইট উল্লেখ করা হলো।
বিভিন্ন দেশের স্কলারশিপের ওয়েবসাইট
দেশের নাম |
ওয়েবসাইট |
যুক্তরাজ্য |
|
যুক্তরাষ্ট্র |
|
অস্ট্রেলিয়া |
|
কানাডা |
|
সিঙ্গাপুর |
|
তুরস্ক |
স্টুডেন্ট ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া
স্টুডেন্ট ভিসা পাওয়া খুব বেশি জটিল কিছু নয়। এক্ষেত্রে প্রথমে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান সেখানে আবেদন করতে হবে, এবং বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে গ্রহণ করতে রাজি হলে তারা একটা Offer Letter পাঠাবে। এই অফার লেটারের সাপেক্ষে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো অফার লেটারে নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ থাকে, যে সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌছে বাকি অফিসিয়াল কাজ সেরে নিতে হয়।
অফার লেটার পাওয়ার পর বাংলাদেশে নিযুক্ত সেদেশের দূতাবাসে যোগাযোগ করে আবেদনপত্র সংগ্রহ করে তা সঠিক তথ্য দিয়ে পূরণ করে জমা দিতে হবে। এছাড়া আবেদনের সময় কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হয়। যেমন-
- পাবলিক পরীক্ষার সনদপত্র
- জন্মসনদ কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র
- সচল পাসপোর্ট
- পুলিশ ক্লিয়ারেন্স
- স্বাস্থ্য বিমাপত্র
- বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত অফার লেটার
- ভাষাগত দক্ষতার সনদপত্র
- আর্থিক সামর্থ্যের প্রমানপত্র
- সদ্যতোলা কয়েক কপি ছবি
এছাড়াও আরো কিছু কাগজপত্রের প্রয়োজন হতে পারে। যা সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে যোগাযোগ করলেই জানা যাবে।
উপরোক্ত কাগজপত্র জমা দিয়ে আবেদন করলে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ সেগুলো যাচাই-বাছাই করে আপনাকে মৌখিক সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকবে এবং সবকিছু সঠিক থাকলে সে দেশে যাবার জন্য স্টুডেন্ট ভিসা ইস্যু করবে।
ইতিকথা
আশা করি উপরে উল্লিখিত তথ্য ও দিকনির্দেশনা আপনার বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। সর্বশেষ বলবো, যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যথেষ্ট সময় নিয়ে চিন্তা করুন, এরপর সিদ্ধান্ত নিন।